
বাংলা স্টার চট্টগ্রাম ব্যুরো-গত পাঁচ দিন ধরে চট্টগ্রাম মহানগরীর কাট্টলী এলাকায় খাল ও সাগরপাড়ে খোঁজা হচ্ছে নৃশংসভাবে খুন হওয়া শিশু আয়াতের লাশের টুকরোগুলো কিন্তু মেলেনি এখনও। এ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে শিশু আয়াতের মা-বাবা। হতাশায় রয়েছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইও।
কারণ হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত হতে শিশু আয়াতের লাশের টুকরোগুলো প্রয়োজন। এমনকি আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণ হিসেবে আয়াতের লাশের টুকরোগুলো দরকার। অন্যথায় জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বিচারকাজেও। যদিও হত্যাকাণ্ডের আলামত হিসেবে শিশু আয়াতের জামা-জুতো এবং রক্তমাখা বঁটি উদ্ধার করা হয়েছে খুনি আবিরের মায়ের বাসা থেকে।
খুনি আবির বর্তমানে দ্বিতীয় দফায় সাত দিনের রিমান্ডে রয়েছে। এর আগে আদালত তার দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে আবির আলীর দেওয়া তথ্যমতে নগরীর কাট্টলী এলাকায় খাল ও সাগরপাড়ে আয়াতের লাশের টুকরোগুলোর সন্ধান চালিয়েছে পিবিআই। এ ছাড়া আবির আলীর দেওয়া তথ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় তার মা-বাবা ও ছোট বোনকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আদালত তিনজনকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তবে বোন অপ্রাপ্তবয়সি হওয়ায় তাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পিবিআই পরিদর্শক মনোজ কুমার দে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ‘মঙ্গলবার সকালে গ্রেফতারের পরপরই তিনজনকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আবিরের বাবা আজাহারুল ইসলাম ও মা মোছাম্মৎ আলো বেগমকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অলিউল্লাহ।’ অন্যদিকে আবিরের ১৫ বছর বয়সি বোনকে তিন দিন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রেখে সমাজসেবা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬-এর বিচারক সিরাজউল্লাহ কুতুবী।
তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে আবিরকে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য পেয়েছি। এরপর আমাদের সন্দেহ, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আবিরের মা-বাবা, বোনের কাছেও কিছু তথ্য থাকতে পারে। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু খোলাখুলিভাবে বলতে পারছি না। যেসব তথ্য আবিরের কাছ থেকে পাওয়া গেছে সেগুলো তার মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে ক্রসচেক করা হবে।’
গত ১৫ নভেম্বর বিকালে নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানার মেয়ে পাঁচ বছর ১১ মাস বয়সি আলিনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হন। ১০ দিন পর ২৪ নভেম্বর পিবিআই আবির আলীকে গ্রেফতার করে। এরপর আবির জানায়, আয়াতকে শ্বাসরোধে খুন করে লাশ কেটে ছয় টুকরো করেছে। এরপর সেগুলো কাট্টলী এলাকায় খালে ও সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে।
আবিরকে নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর দুপুরে এবং রোববার পিবিআই টিম তার বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলগুলোতে গিয়ে লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এরপর তার দেওয়া তথ্য আরও যাচাই এবং আনুষঙ্গিক প্রমাণ সংগ্রহে পিবিআই তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে। প্রথম দফায় গত ২৬ নভেম্বর আবিরকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত। সোমবার দ্বিতীয় দফায় আরও সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
পিবিআইয়ের ভাষ্যমতে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণের পরিকল্পনা করে তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আজহারুলের ছেলে আবির আলী।পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ আবিরকে আয়াত চাচ্চু বলে সম্বোধন করত। ১৫ নভেম্বর বিকালে বাসার সামনে থেকে আয়াতকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে আবির ঢুকে যায় তার বাবার বাসায়, যেখানে তখন কেউ ছিল না। সেখানে ১৫ মিনিটের মধ্যে শ্বাসরোধ করে আয়াতকে খুন করে আবির।
এরপর লাশ ব্যাগে ভরে নিয়ে যায় নগরীর আকমল আলী সড়কের পকেটগেট বাজার এলাকায় তার মা আলো বেগমের বাসায়। মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদের পর আবির মায়ের বাসায় থাকত। তবে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা যে এলাকায়, সেই বাবার বাসায়ও তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আবির মায়ের বাসায় নিয়ে লাশ বাথরুমের ছাদের ওপর লুকিয়ে রাখে। রাতে সেই লাশ বাথরুমে নিয়ে কেটে ছয় টুকরা করে ছয়টি ব্যাগে ভরে রাখে।
পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে লাশের তিনটি টুকরা নগরীর আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে বেড়িবাঁধের পর আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকায় সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ওইদিন রাতে বাকি তিন টুকরা আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে একটি নালায় সুইচগেটের প্রবেশমুখে ফেলে দেয় আবির।
মুক্তিপণ আদায়ের জন্য সংগ্রহ করা সিম ব্লক থাকায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি আবির। আয়াতের খেলার সাথীদের কাছ থেকে তাকে কোলে নেওয়ার তথ্য এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আবিরের গতিবিধি দেখে তাকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন, ‘আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ পেয়েছি। যার একটি নেভি গেট এলাকার। রিকশায় করে আবির পলিথিনে মোড়া টুকরা মরদেহ নিয়ে যাচ্ছে- এমন দৃশ্য আছে সেখানে। আরেকটি ফুটেজ একটি দোকানের। সেখান থেকে আবির বঁটি, স্কচটেপ ও এন্টিকাটার কিনেছে।’ আয়াতের বাবা সোহেল রানা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকায় মামলার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
আয়াতের দাদা মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘মামলা করছে সোহেল, ক্যামনে কী করছে জানি না। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। যারে (আবির) পুলিশ ধরেছে, তার আমরা ফাঁসি চাই।’
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘পুলিশ অলরেডি হত্যার আলামত পেয়েছে। রক্তমাখা বঁটি, এন্টিকাটার-এগুলো তো গুরুত্বপূর্ণ আলামত। আর গ্রেফতার করা আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পেলে অপরাধ প্রমাণে তেমন কিছুই লাগবে না।