
স্টাফ রিপোর্টার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বদলে গেছে। বদলে গেছে শিখন-শেখানো পদ্ধতি। বদলে গেছে শিক্ষা উপকরণও। এসবের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে পাথরের স্লেট আর বিশেষ ধরনের পেন্সিল এবং চকের ব্যবহাও কমে গেছে অনেকখানি। অনেক আগে থেকেই হোয়াট বোর্ড আর মার্কারি পেনের প্রচলন শুরু হয়েছে অধিকাংশ স্কুলে। কালো বোর্ডের ব্যাবহার কমেছে অনেক। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে প্লাস্টিকের কিছু স্লেট দেখা যায়। যেগুলো সরকারিভাবে কয়েক বছর আগে দেওয়া হয়েছিল। তবে কারিকুলাম বদলে যাওয়ায় এখন আর সেগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। এখন শিশুদের হাতেখড়ি হয় ডিজিটাল ডিভাইসে। ১৯৯০-৯১ সালের পর থেকে পাথরে তৈরি স্লেট-পেন্সিল হারিয়ে যেতে থাকে বলে বই ব্যবসায়ী এবং শিক্ষক-অভিভাবকরা জানিয়েছেন।
পাঁচ দশক আগে পাথরের স্লেট-পেন্সিল দিয়ে হাতের লেখা শেখানো হতো। স্লেটে লেখার পেন্সিলটাও থাকতো কার্বন দিয়ে তৈরি পাথুরে টাইপের। কয়লা দিয়ে স্লেট ধুয়ে ঝকঝকে করার কাজটিও তারা নিজ হাতে করতেন। বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে দোয়াতে বানানো ময়ূর কালিতে তালপাতায় লেখার অভিজ্ঞতাও রয়েছে অনেকের স্মৃতিতে। এখন প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে লেখার উপকরণ বদলে গেছে। এখন কালির কলম বিদায় নিয়ে এসেছে বল পয়েন্ট পেন। এখন আধুনিক যন্ত্রে তৈরি কাগজ আর রঙিন বই উঠেছে শিশুদের হাতে।
গ্রামের ভাঙা দোচালা স্কুলঘরে বর্ণ পরিচয় হয়েছে অনেকের। ঘর আর বেঞ্চের অভাবে খোলা আকাশের নিচে সবুজ দুর্বা ঘাসে দলবেঁধে বসে সুর করে ধারাপাতের নামতা পড়েছেন । স্কুল ছুটিতে হৈ হৈ করে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। কখনো হাঁটু সমান পানি ভেঙে কাদা মাড়িয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। এখন প্রতিটি গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আর দু-তিন গ্রাম পরই হাইস্কুল। এখন স্কুলগুলো সুসজ্জিত, দ্বিতল, তিনতলা ভবন। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে প্রথম শ্রেণির আগে প্লে, নার্সারি, কেজি ইত্যাদি নামের ক্লাস যোগ হয়েছে। তবে এখন স্কুলঘর রঙিন হলেও শিশুরা তাদের সাত রঙা শৈশব হারিয়েছে। ক্লাস শুরুর আগে-পরে তিন-চারটা প্রাইভেট পড়া কিংবা পড়ন্তবেলায় বস্তাসম স্কুলব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের।
বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি তাদের শৈশবকালে স্লেটের চক বানানোর কৌশল জানালেন। সেসময় তারা গোসল করতে গিয়ে পুকুরের পাড় থেকে নরম এঁটেল মাটি দলা বানিয়ে তুলে আনতেন। তারপর সেটা প্রথমে ছেনে হাতের তালুতে নিয়ে মাটির ওপর ঘষে লম্বা আকৃতি দেওয়া হতো। এরপর রোদে শুকিয়ে সেগুলোকে মাটির চুলায় রান্না শেষে যে আগুন থাকে, সেই আগুনে ফেলে ঢেকে দেওয়া হতো। এরপর একসময় সেই আগুনের ছাইগুলো ফেলার সময় বেছে বেছে চকগুলো আলাদা করে নেওয়া হতো। হাতে বানানো এই চক সাধারণ চকের মতো অতটা মোটা হতো না। এগুলোর বর্ণও সাধারণ চকের মতো সাদা হতো না; বরং মাটির রং অনুযায়ী একেকটা একেক রঙের হতো। সেগুলো দিয়ে স্লেটে লেখা হতো। আর লেখা মুছে ফেলার জন পুরোনো কাপড়ের একটা ছোট পুঁটলি ব্যবহার করা হতো। সেটা পানিতে ভিজিয়ে মোছার কাজে ব্যবহার করা হতো। ওদিকে, স্লেটে লেখার কাজটা চলতো। চক তৈরি আর মোছার পুটলি বানানোর কাজে শিশুদের মায়েরা সাহায্য করতেন।
চাঁদপুরের অধিকাংশ স্কুলে স্লেটের ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। ৫-৬ বছর আগে বিদ্যালয়গুলোতে প্লাস্টিকের স্লেট আকৃতির বোর্ড সরবরাহ করা হয়েছিল। অনেক স্কুলে সেগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। সেগুলো এখন ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এখন বর্ণ শেখানোর আধুনিক উপকরণ ডিজিটাল ডিভাইস থেকে শুরু করে প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া নতুন ক্যারিকুলামে শিশুদের জন্য বিশেষ ধরনের বই এবং খাতা সরবরাহ করা হয়েছে। সেখানেই শিশুরা লেখে।
অধিকাংশ স্কুলে এখন সবচেয়ে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা এখন লেখেন পেন্সিল দিয়ে। চক স্লেটের ব্যবহার তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে এখনই যাদের হাতে খড়ি হচ্ছে তাদেরকে অনেক পিতামাতা অনেকটা সখ করেই চক স্লেট কিনে দিতে চান। তবে বাজারে গিয়ে যখন দেখেন ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে চক স্লেটের মতো দেখা যায় তখনে সেটিতে আকৃষ্ট হয়ে কিনে নিতে ভুল করেন না। এই ডিজিটাল ডিভাইসে যেমন লেখা যায় তেমন মোছা যায় নিমিষেই। এমনটি কোন প্রকার নোংড়া করা ছাড়াই লেখা যায় মোছা যায়।
পেন্সিল-কলম-ইরেজারের দামও বাড়তি ৩০-৫০ শতাংশ
কাগজের বাড়তি দামে ধুঁকছে মুদ্রণশিল্প। নতুন বছর নতুন বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ভর করেছে আগেই। দাম বেড়েছে সব ধরনের সৃজনশীল কিংবা সহায়ক বইয়ের। অন্য শিক্ষা উপকরণেও স্বস্তি নেই। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভালোমানের একটি পেন্সিলের দাম খুচরায় এখন ২০ টাকা, যা মাসখানেক আগেও ১৫ টাকা ছিল। পেন্সিলের দাগ মুছতে ব্যবহৃত ইরেজার বা রাবারের দাম হয়েছে দ্বিগুণ। কলমের দাম মানভেদে বেড়েছে দুই থেকে ২০ টাকা। আর বাড়তি দামের এ বোঝা বইতে হচ্ছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের। নতুন বছরের জন্য যা খুব সুখকর নয়।
গত কয়েক মাসে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব এভাবেই এসে লেগেছে শিক্ষা উপকরণেও। বই, খাতা, কাগজ, কলম পেন্সিলসহ প্রায় সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে, যা ভোগাচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে।
এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি আমাদের মতো মধ্যবিত্তের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। কিন্তু শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার বিষয় সেভাবে আলোচনায় আসে না। কেউ দেখেও না। সরকারেরও কোনো মাথাব্যথা নেই। নি¤œবিত্ত মানুষরা পড়াশোনা চালাতে নিরুৎসাহিত হবে। এমনকি পড়াশোনা বন্ধও করে দিতে পারে কেউ কেউ। যেটা ওই পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হবে।