29 C
Bangladesh
Saturday, September 30, 2023
spot_img

ডেঙ্গুর নতুন উপসর্গে মৃত্যু বাড়ছে হাসপাতালে

বাংলা স্টার রিপোট-আট বছর বয়সী সামিয়ার বাড়ি শরীয়তপুরে। সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জ্বরে যন্ত্রণাকাতর মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা। গতকাল তোলা। ছবি : মঞ্জুরুল করিম

সারা দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত এক দিনে আরো এক হাজার ৭৫৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে আরো ৯ জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হওয়ায় মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।

নতুন উপসর্গে মৃত্যু বাড়ছেডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সাধারণ শারীরিক উপসর্গ হলো জ্বর, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা ইত্যাদি। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে নতুন কিছু উপসর্গ যোগ হওয়ার তথ্য দিয়েছেন চিকিৎসকরা। যেমন—জ্বর না হওয়া, ডায়রিয়া হওয়া, বারবার বমি হওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, শরীরে পানি জমে যাওয়া, মস্তিষ্কে প্রচণ্ড প্রদাহ এসব বেশি হচ্ছে।

রাজধানী ঢাকার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক রোগীর তিন-চার দিনের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া হচ্ছে।
ওই রোগী কিন্তু প্রথমে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসছে না। রোগী ডায়রিয়ার সাধারণ যে চিকিৎসা, সেটি করছে। আবার অনেকের জ্বর নেই, ব্লাড প্রেসার কমে গেছে, ওই রোগী প্রথমে আসছে না। বাড়িতে থেকে বিভিন্ন ওষুধ খাচ্ছে, চিকিৎসা নিচ্ছে সে।

পরিস্থিতি যখন গুরুতর হচ্ছে, তখন হাসপাতালে আসছে। মূলত এসব কারণে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া এসব রোগীর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি।

আরো ৯ মৃত্যু, হাসপাতালে এক হাজার ৭৫৫

গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, দেশে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৯ জনের মধ্যে ঢাকার আটজন আর ঢাকার বাইরে একজন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৫৫ জন মারা গেল।

গত এক দিনে আরো এক হাজার ৭৫৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৮৪৫ জন ঢাকার এবং ৯১০ জন ঢাকার বাইরের। এক দিনে এই প্রথম ঢাকার চেয়ে বাইরের রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট পাঁচ হাজার ৯৩৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে দুই হাজার ৪১৫ জন। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ২৭ হাজার ৫৪৭ জন। এর মধ্যে শুধু জুলাই মাসের প্রথম ২০ দিনে ১৯ হাজার ৫৬৯ জন ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে মারা গেছে ১০৮ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর মোট তিনটি পর্যায় রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ফেব্রিল ফেজ বা জ্বর পর্যায়, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল ফেজ বা গুরুতর পর্যায় এবং তৃতীয়টি কনভালেসেন্ট ফেজ বা নিরাময় পর্যায়।

হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরালে ব্যবস্থা

জায়গা না থাকার অজুহাতে হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ফিরিয়ে দেওয়া হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

গতকাল দুপুরে রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ের এফডিসিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা নিয়ে ছায়া সংসদ বিষয়ক ইউসিবি পাবলিক পার্লামেন্ট বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।

ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতালগুলো ভরে যাচ্ছে, তবে এ পরিস্থিতি এখনো মহামারি পর্যায়ে যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ‘মহামারির একটা ব্যাখ্যা আছে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান ডেঙ্গু অবস্থা যায় না বলে আমি জানি। তবে এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। আমি এই প্রশ্নটা তাঁদের কাছেই রাখব।’

সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সতর্ক করা জরুরি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘আমরা দুটি পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করছি। একটা রোগীর কাজ এবং আরেকটা চিকিৎসকের কাজ। যদি কারো জ্বর হয় এবং অন্য কোনো রোগ যদি মনে না হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে পরীক্ষাটা করাতে হবে। এটা রোগীর কাজ। আর চিকিৎসকের কাজ হলো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সেবা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে বিপদচিহ্নগুলো বুঝিয়ে দেওয়া। সব দায়িত্ব শুধু চিকিৎসার ওপর ছেড়ে দিলে হবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জরুরি পরিস্থিতির মতো কাজ করছি। এর মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা, সব জায়গায় চিকিৎসা সরঞ্জাম দেওয়া, চিকিৎসক-নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। কিন্তু যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষ করে সামনে আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর—এই তিন মাস ডেঙ্গুর সমস্যাটা থাকবে। এর আগেই নিয়ন্ত্রণের কাজটা করতে হবে।’

জ্বর কমে যাওয়ার পর অবস্থার অবনতি

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, রোগীর জ্বর চলে যাওয়ার পর অবস্থা বেশি খারাপ হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী ও রোগীর স্বজন মনে করে, জ্বর তো চলে গেছে, মানে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। মূলত এই জ্বর কমেই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এই ক্রিটিক্যাল পিরিয়ডে দেরিতে চিকিৎসা নিলে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্রধান চিকিৎসা হলো ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী তরল খাবার যত বেশি খাবে, ঝুঁকি তত কমবে। অন্যথায় শরীরে পানি কমে গিয়ে কিডনিসহ একাধিক অঙ্গ কাজ না-ও করতে পারে। এতে রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়।

জনগণের সম্পৃক্ততা জরুরি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. একরামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিগত বছরগুলোতে জুলাই মাসে এ রকম ‘পিক’ হতে কখনো দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে যদি মশার উৎসস্থল ধ্বংস করা না যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা স্কুল ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতার কাজ করছি। এ সময় জনগণকে সম্পৃক্ত করা খুব জরুরি। মানুষকে বোঝাতে হবে যে নিজের আঙিনা পরিষ্কার না রাখলে তার নিজের ক্ষতিটা প্রথমে হবে। পরিবারের মানুষকে এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু হতে পারে।’

এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবীরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে, সামনে আরো খারাপ হতে পারে। আমরা এই পরিস্থিতি ঠেকাতে পারব কি না তা জানি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখনো যদি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে আর নিয়ন্ত্রণ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’

অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলেন, ‘এখন করণীয় হলো প্রতি ৫০০ বাড়ির জন্য একজন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া। সেই স্বাস্থ্যকর্মীকে অনেক বেশি শিক্ষিত হতে হবে না, এসএসসি পাস হলেই চলবে। যিনি এসব বাড়ির মালিকের ফোন নম্বর রাখবেন এবং প্রতি সাত দিন পর একবার যাবেন। ঘুরে ঘুরে দেখবেন। অর্থাৎ দেশে ভ্যাকসিন ও ফ্যামিলি প্ল্যানিং কর্মসূচি যেভাবে চলেছে, ঠিক সেভাবে কাজটি করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে একটা প্রজেক্ট নিতে হবে।’

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
3,875FollowersFollow
21,200SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles